:: জাকি ফারুকী :: জীবন আসলে কখন কি চায় জানিনা। সামনে যা দরকার তাই করে যাচ্ছি। লালমনিরহাট এক লম্বা নষ্টালজিয়া… এর শেষ নেই সীমা নেই।
প্রীতম কর্মকারের লালমনিরহাট রেলওয়ে স্টেশনের ওপর একটা ছোট্ট ভিডিও ক্লিপ ফেসবুকে
জনৈক জাকিউল ইসলামের
আই ডি তে চোখে পড়লো।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া রবীন্দ্রসংগীত ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজছে, স্টেশনের ছবি, ওভারব্রীজ, সাউথ কেবিন, অলস মানুষের বসে থাকা, জীবন প্রবাহের নানান অনুসঙ্গ সব মিলে জীবনের স্মৃতিজাগানিয়া এক আশ্চর্য মিথ বুকের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হতে থাকে।
জন্মের পর প্রথম পাঁচবছর লালমনিরহাট, মস্তিস্কের কোষে গেঁথে গেছে।
আমার প্রায় সত্তর বছরের জীবনের ১৯৬৭-৮৬
মাঝের এই ১৯ বছর শিক্ষার জন্য অন্য গ্রাম ও শহরে অবস্থানের কারণে বাদ দেয়া এই সময়টা বাদে, আমি সতত আমার লালমনিরহাটকে নিজের মন ও মননে সর্বাত্মক শুদ্ধতা নিয়ে কাজ করে গেছি।
একটা জীবন চলে গেলো, চলেই গেলো।
বাবু পাড়ার প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত দোতালা সেই বাড়ী গুলোর ছাদে, কাশফুল দেখে, মাঝে মাঝে মতিভ্রম হয়, আমরা আমাদের তিনটে প্রজন্মের স্মৃতিকে কতো সহজে, হারিয়ে যেতে দিলাম।
স্টেশনের ওভার ব্রীজটা অযুত মানুষের কাছে দীর্ঘ প্রজন্মের এক স্মরণীয় উত্তরাধিকার।
ডাকু মামা, কমল মামা, রুমী, পিল্টু ভাই, মাঝে মাঝে গোরা মামা, এঁদের যখন দীর্ঘ সময় ধরে ওভার ব্রীজের ওপর আড্ডা দিতে দেখতাম, তখন মনে হতো, এদের কতো গল্প আছে জীবনের, যে শেষ হয় না।
এই স্টেশনের পরতে পরতে, প্রতিটি বেঞ্চে কতো মানুষের অজস্র স্মৃতি।
মনে হাসি ভরে যায়, কখনো জল ভরে আসে দুচোখে, কখনো রাগ হয়, মনে হয় স্টেশন আরো গতিশীল হয়না কেন?
১৯৭২-৮০ ঝিম মেরে পরে থাকা স্টেশনের স্থবির অবস্থাটা মনে হয় ভালো ছিলো।
অনেক আড্ডা মারা যেতো।
কি মনে হয়?
এখন মনে হয়, আবার গেলে আড্ডা দিতাম নানান বয়সের ভিন্ন প্রজন্মের সাথে।
অনেক লেখক তৈরী হয়েছে, এই ওভার ব্রীজের আড্ডা থেকে, ওদের সবাইকে নিয়ে বসতাম, সবার কথা শুনতাম। মুগ্ধতা বাড়তো, সাথে রাতের গভীরতা।
সবজি খিঁচুড়ী ডাল ভর্তা, অসংখ্যবার অব্যাহত চা… উহ্ ভাবাই যায় না।
১/৫/২৪ টিনটনফলস, নিউজার্সি।
–
মানুষ মাটিতে হেঁটে বেড়ায়।
ওপরে ওঠা খুব কম হয়। এখন কিছু উঁচু দালানে মানুষ উঠে কাজ করে। তাও খুব সীমিত সংখ্যক।
তাই প্রথম পাহাড়তলীর বাটালী হিলে যখন উঠি তখন আমার বয়স পাঁচবছর। পাহাড়তলীতে ছিলাম মাস ছয়। পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়ানো,
পুরাতন কবরে মোমবাতি গলে ম্যুরাল হওয়া অসমাপ্ত মোম গুলো বাসায় এনে খেলা, পাহাড়তলীর পাহাড়ের বিশাল কবরস্থান, এসব এখনো স্বপ্নে মাঝে মধ্যে ধরা দেয়।
তারপর সৈয়দপুরে পাঁচটা বছর খুব চাপ গেছে।
ক্লাসে প্রথম হতে পারতাম না। আমার চেয়ে ভালো ছাত্র হামিদুজ্জামান, ফরহাদ, শরীফ এদের বিট করা যেতো না।
ফাইভে ১৯৬৫ লালমনিরহাট এসে ভর্তি হলাম, মডেল হাই স্কুলে।
স্কুলের পর সারাক্ষন বেড়ানো পথে পথে।রেলওয়ে হাসপাতালের উত্তর পাশে, লাশকাটা ঘরটার পশ্চিমের বাসাটায় থাকতাম। দিনের বেলা ভালো, রাত হলেই ওই লাশঘরের ভয় চেপে বসতো ঘাড়ে।
নাগলিঙ্গমের বিশাল অন্ধকার গাছটা, রেলওয়ে ডাক্তারের বাসার সামনে, আর একটা ভূতের আশ্রয়।
ডা. রহমানের বাসার পূর্বে দেয়ালের পাশের একটা বেল গাছ কম ভীতিকর ছিলোনা।
তারচেয়ে রেলের ওভার ব্রীজ দারুন।
তখন রেলওয়ের পাওয়ার হাউজ থেকে বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত ছিলো কিছু বাড়ীঘর আর স্টেশন।
মাটির থেকে প্রায় সতেরো ফুট ওপর থেকে, বিশাল স্টেশন, সারি সারি মালগাড়ী, প্যাসেঞ্জার ট্রেনের আসা যাওয়া,
কয়লার ইঞ্জিন যখন ওভার ব্রীজের নীচ দিয়ে যেতো, তখন কালো ধোঁয়ার একটা দমবন্ধ করা অনুভব, এসব দেখতে খুব মজা পেতাম।
সেই ছেলেবেলায় একা একা ঘুরবার এই ওভার ব্রীজের স্মৃতি ছিলো অসামান্য।
কিছু লোক ট্রেন ছেড়ে দিলে, পিছনে দৌড়াতো ট্রেন ধরার জন্য, গার্ডকে অনুরোধ করতো ট্রেন স্লো করার জন্য, কে শোনে কার কথা। ভুষভুষ করে প্লাটফরম ছেড়ে বের হয়ে যেতো ট্রেন।
এতো রকমের মানুষের দেখা পাওয়া যেতো, বিশেষ করে বুট আর বাদাম ওয়ালা।
সে সময় কানাপয়সা ছিলো, আধ আনার কয়েন ছিলো, এক আনা দুই আনা চার আনা আটআনা একটাকা।
দু আনার চানাচুর খেয়ে শেষ করা যেতো না।
আর সে দুআনা পাবোই বা কোথায়।
মডেল স্কুলে আমি প্রথম পরীক্ষা দিয়েই রোল নম্বর এক হয়ে গেলো।
আমাদের সাথে মান্নান পড়তো, আদিতমারীর উপজেলা চেয়ারম্যান হয়েছিলো।
সে তার বাবার তামাক ব্যবসার কারণে অনেক খুচরা মুদ্রার নাড়াচারা করতো।
তখনকার দিনে ব্রিষ্টল সিগারেট আর মিষ্টি খাওয়ার ওদের আনন্দ দেখে অবাক হতাম।
আমার পরীক্ষার ভালো রেজাল্ট হবার পর ও মাঝে মাঝে আমাকে খাতির করে চানাচুর মাখা খেতে ডাকতো।
পুরাতন লেখার কাগজে, বা পেপারে ওসব খেতে দিতো বলে আমার অস্বাস্থ্যকর মনে হতো ওসব খাওয়া, তারপরও লোভ সামলাতে পারতাম না।
সেই সব দিনে, হাইস্কুলের মাঠে পিটি করানোর লাইন করতে শয়তানির কারনে, হামিদ আর জহির স্যারের বেতের গনপিটুনীর কথা এখনো মনে পরে।
মহিবুল্লাহ্, মনজু, আলতাফ, রিয়াজুল, মাইকেল, যারা ফুটবল খেলতো, তাদের মহা দুষ্টমির কথা এখন মনে হলে অনেক আনন্দ পাই।
রেলের ওভার ব্রীজে বেশীরভাগ আড্ডা ছিলো চিলড্রেন পার্ক স্কুলের ছেলেদের। বাবুপাড়ার দক্ষিণে কোয়ার্টারের মাঝখানে, একটা আশ্চর্য স্কুল চলতো, যার ছাত্র ছাত্রীরা, দেশের অনেক নামজাদা প্রতিষ্ঠানে চাকরী করেছেন, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, প্রশাসক, ব্যবসায়ী, শিক্ষক, কি বাদ ছিলো তাঁদের?
এই ওভার ব্রীজে ১৯৫০ থেকে আজ পর্যন্ত এই সত্তর বছরের অযুত মানুষের পদধুলি আর স্মৃতি, লালমনিরহাটকে অনেকের মানসপট থেকে কখনো মুছতে দেয়নি। ওপর থেকে পৃথিবী দেখার এই সহজ সুযোগ যে কোন মানুষের কাছেই বিনে পয়সার বায়োস্কোপ দেখার মতো।
সবচেয়ে বড়ো কথা টিকেট ছাড়া এই বিশ্বদর্শনের মহান অনুভব সব ধরনের মানুষের মাঝেই সংক্রামিত হয়েছে।
তাই আমার মনে হয়, প্রীতম কর্মকারকে বলি, এই ওভারব্রীজকে উপজীব্য করে, আরো অনেক ধরনের সংবেদনশীল কোন কিছু যদি তৈরী করা যায়, নুতন ভাবে মানুষের সামনে পুনঃস্থাপিত করা যায়, মনে হয় ভালই হবে।
যেকোন চিন্তা এই ওভারব্রীজ কে কেন্দ্র করে লিখে পাঠালে, পরবর্তীকে সিদ্ধান্ত নিতে সহজ হবে।
জাকি/ ১/৫/২৪ নিউজার্সি